প্রাক্তন বা EX। শব্দটি শুনলে প্রথমে আপনার মাথায় কি আসে? আগের প্রেমিক-প্রেমিকা, স্বামী-স্ত্রী যারা এখন আর সাথে নেই। যদি তাই হয় তাহলে বলতে হয় আপনি স্বল্প চিন্তা-ভাবনায় সীমাবদ্ধ। হুম প্রাক্তন বলতে বোঝায় যা আমাদের জীবনে আগে ছিলো এখন নেই বা আছে কিন্তু আমাদের সাথে নেই। কিন্তু প্রাক্তন শব্দটি এতোটুকুর মধ্যেই আবদ্ধ নয়। এর আছে গভীরতা, আছে স্বার্থকতা। যা আমাদের জীবনের সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে। জড়িয়ে আমাদের প্রতিটা মূহুর্তে। আর এটাই আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় সত্যি। আমাদের ভালো-খারাপ স্মৃতি। কথাগুলো হাস্যেকর মনে হলেও এটাই সত্যি। কিভাবে জানেন? কারণ আমাদের জীবনের সবই প্রাক্তন। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত চলতে থাকে এই প্রক্রিয়া। আমাদের জীবনের সূচনা হয় মাতৃগর্ভে। সেখানে আমারা ধীরে ধীরে বড় হই। নয়টা মাস সেখানেই অবস্থান করি। এরপর আমাদের আগমন ঘটে পৃথিবীতে। শুরু হয় প্রাত্তনের। আমাদের প্রথম প্রাক্তন মাতৃগর্ভ। এরপর সবার কোলে কোলে ঘোরা, আঙুল ধরতে শেখা, উঠে বসতে শেখা, হামাগুড়ি শেখা, হাঁটতে শেখা, বলতে শেখা এসবের মাধ্যমে আমরা ধীরে ধীরে বড় হতে থাকি। এরপর সারাজীবনই হাঁটি কিন্তু আবার হাঁটতে শিখি না, সারা জীবন কথা বলি কিন্তু বলতে শিখি না। হুম একটা সময় শেখায় কিন্তু শিখি কি? না শিখি না। কারণ শেখাটা একটা সময়ে সীমাবদ্ধ। যাকে প্রাক্তন করে আমরা এগিয়ে যায় সামনের দিকে। ছোট বেলার ভেঙে যাওয়া খেলনাটা ফেলে দেওয়ার পর তার কি হয় জানি না। হয়তো পচেঁ গলে মিশে যায় মাটিতে। নয়তো কোনো ময়লা কোড়ানোর ব্যাগে করে চলে যায়। পছন্দের জিনিসগুলো যেগুলো আমরা আগলে রাখতে চাই সেইগুলোই আমাদের জীবনে থেকে হরিয়ে যায়। যাই হোক না কেন সবকিছু পেছনে ফেলে আমাদের এগিয়ে যেতে হয় সামনের দিকে। সময় আসে স্কুলে ভর্তির। ভর্তি হই স্কুলে। শিখি জীবনের পাঠ। পরিচিত হই অপরিচিত মানুষের সাথে। নাম হয় সহপাঠি। ধীরে ধবন্ধুত্ব তৈরি করতে। সৃষ্টি হয় নতুন সম্পর্ক, নতুন অনুভূতি। এরপর এক ক্লাস পেরিয়ে অরেক ক্লাস, এক বছর পেরিয়ে আরেক বছর এভাবে করে এক সময় চলে আসে স্কুল জীবনের অন্তিম মুহূর্ত। তারপর স্কুলটাও প্রাক্তন। তার সাথে স্কুল জীবনের বন্ধু-বান্ধব, শিক্ষক, ক্লাসরুম, স্কুল জীবনে কাটানো আনন্দের মুহূর্তগুলো, দীর্ঘ একটা অধ্যায় প্রাক্তন হয়ে যায়। এরপর শুরু হয় জীবনের আরেকটি অধ্যায়। কলেজ জীবন। দীর্ঘ জীবনের ছোট একটা অধ্যায় কলেজ জীবন। যা গোছানোর আগেই শেষ হয়ে যায়। হয়তো পাওয়া যায় দু-একজন আগের বন্ধুকে, কিংবা কাউকেই পাওয়া যায় না। তৈরি হয় নতুন বন্ধুত্ব। নিয়মিত না হলেও কথা হয় আগের বন্ধুদের সাথে হয়তো মাঝে মাঝে দেখাও হয়। সময় কাটে নতুন বন্ধুদের সাথে। বন্ধুত্ত্বটা গাঢ় হওয়ার আগেই সময় জানিয়ে দেয় এবার যেতে হবে। এই অধ্যায়টাও শেষ হয়ে যায় এগিয়ে চলে সময়। এগিয়ে চলে জীবন। স্কুল-কলেজের সহপাঠিদের পথ এখন আলাদা। কেউবা মেডিকেল, কেউবা বুয়েট, কেউবা নার্সিং, কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ইউনিট নিয়ে তাদের স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। কেউবা পরিবারের দুরাবস্থার জন্য পড়াশোনা বাদ দিয়ে নিয়েছে পরিবারের দ্বায়িত্ব। কেউবা আবেগের বশে জীবন নষ্ট করে ফেলছে চোখের পানি। কেউবা অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কোনো মতে এগিয়ে নিচ্ছে পড়াশোনাকে। কেউবা সংসার সামলে বাকিটা সময় দিচ্ছে পড়াশোনায়। কেউবা তার নতুন সংসার গুছিয়ে পড়াশোনার সময় বের করে নিচ্ছে। কেউবা পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরি খুজতে ছুটছে। এখন সবাই খুব ব্যস্ত। সবাই ব্যস্ত তার ভবিষ্যৎ গোছাতে। এই জীবনটাও শেষ হয়ে যায় এবার সবার স্বপ্ন পূরণের পালা। কেউ কেউ তাদের স্বপ্ন পূরণ করতে পারে আবার কারো কারো স্বপ্ন ভেঙে গিয়ে, এতোদিনের পরিশ্রম বৃথা হয়ে সময় কাঁটে বিষন্নতায়। বেকার না থেকে শুরু করে কোনো একটা কাজ যা সে কখনো করতে চায়নি। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে সময় কাটানো ছেলেটাও এখন বুজদার হয়ে গেছে। সবসময় বাতাসের মতো ছুটে চলা মেয়েটাও শান্ত হয়ে গেছে। বড় হয়ে গেছে তো এখন কি আর এসব মানায়। ব্যস্ততা, দায়ব্দতার আড়ালে চাপা পড়ে যায় বন্ধুদের সাথে কাটানো মূহুর্তগুলো। মাঝে মাঝে অবসর সময় স্মৃতি হয়ে ভেসে উঠে মনের পর্দায়। মুখে ফুটে উঠে এক চিলতে হাঁসি, বুকের বাম পাশটায় অনুভূত হয় সামান্য চিনচিন ব্যথা। এই ব্যথা হৃদপিন্ডের কোনো সমস্যার জন্য নয়। সুখস্মৃতির বিদ্ধ তীরের জন্য। যেই স্মৃতিগুলো এখন প্রাক্তন। মাঝে মাঝে বন্ধুদের কথা মনে পড়লেও এখন আর সময়ের অভাবে বা ব্যস্ততার জন্য তাদের সাথে কথা বলা হয় না, দেখা করা হয় না। কিংবা জীবনে ব্যর্থ হওয়ার কারণে বন্ধুদের সাথে দেখা করতে ইচ্ছা করে না। কখনো দেখা করার পরিকল্পনা করলে কারো সময় হয় কারো হয়না। তাই পরিকল্পনাটাও বাস্তবায়ন হয় না। বন্ধু-বান্ধবের বেশিরভাগই এখন বিবাহিত। কারো কারো হয়তো ১-২জন বাচ্চাও আছে। কারো বাচ্চা হয়তো স্কুলে পড়ে। হঠাৎ কোনো একদিন রাস্তায় দেখা হয়ে যায় পুরোনো বান্ধবীর সাথে। সাথে একটা বাচ্চা। কথায় কথায় জানা হয়ে যায় বাচ্চাটা তার। বাচ্চাটাকে বলে আমার স্কুল/কলেজ জীবনের বন্ধু, তোমার খালা মণি হয়, জিঙ্গাসা করো কেমন আছে। ঠিক যেমন ছোটবেলায় আমাদের বাবা বা মায়ের সাথে কোথাও গেলে তাদের পুরনো বন্ধু-বান্ধবের সাথে দেখা হলে তারা আমাদের বলতেন। এখন সেটা আমরা বলি। কারণ সেই সময়টাকে প্রাক্তন করে আমরা এগিয়ে গেছি অনেকটা সমনে। ধীরে ধীরে বয়সের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। এদিকে আমাদের চুলগুলোর ধীরে ধীরে কালো রংকে প্রাক্তন করে সাদা রংকে আপন করে নেয়। আমাদের ছেলে-মেয়েরাও স্কুল শেষ করে কলেজ। কলেজ শেষে বিশ্ববিদ্যালয়। থেমে নেই তাদের জীবনও। তাদের বিয়ে হয়ে যায়। বাচ্চা-কাচ্চা হয়। আগের মা-বাবা, চাচা-ফুফু, মামা-খালার সাথে যোগ হয় নতুন পরিচয় দাদা-দাদি, নানা-নানি। সময় কাটে নাতি-নাতনিদের সাথে। তাদের শোনানো হয় আমাদের প্রাত্তনের গল্প অর্থাৎ আমাদের ছোট বেলা, স্কুল, কলেজ, বন্ধু-বান্ধবের গল্প। আগের টান টান চামড়াটা কবেই প্রাক্তন হয়ে গেছে। তা এখন আরো কুচকে গেছে। চোখের দৃষ্টি, দৈহিক শক্তি, স্মৃতি শক্তি, শ্রবণ শক্তি অনেক ক্ষীণ হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে সবকর্ম ক্ষমতা হারিয়ে নিজেকে সবার বোঝা মনে হতে শুরু করে। এখন আর একা কোথাও যাওয়ার ক্ষমতাও নেই। আগের বন্ধু-বান্ধবরা হয়তো কেউ কেউ আর নেই এই পৃথিবীতে। কেউ কেউ হয়তো ছেলে-মেয়ে, ছেলের বউ নিয়ে সুখে আছে। কেউ কেউ হয়তো নিজের বাসায় অবহেলিত, কাজের লোকের মতো জীবন যাপন করছে। কাউকে হয়তো পরিবার বোঝা মনে করে পাঠিয়ে দিচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে। কেউ হয়তো ভালো মনের ছেলের বউ পেয়ে অত্যাচার করছে। নাতি-নাতনি বড়ো হয়, আমাদের স্মৃতি শক্তি আরো কমে যায়। হঠাৎ ছোটো বেলা বা স্কুল, কলেজের কোনো ঘটনা মনে পড়লে তাদের বলা হয়। দৈহিক শক্তি কমে যাওয়াতে হাজারো রোগের বাসস্থানে পরিণত হয়। বোঝার ক্ষমতাটাও কমে যায়। তাই পরিণত হতে হয় সবার বিরক্তিতে। ধীরে ধীরে কথা বলার, বিছানা থেকে উঠার, নিজের খাওয়ার ক্ষমতাটাও থাকে না। কেউ সময় পেলে এসে খায়িয়ে দেয়, সময় না পেলে বৃদ্ধ বা বৃদ্ধার কথা কারোর মনে থাকে না। পেটে ক্ষিদে নিয়েই সুয়ে থাকতে হয়। আর অপেক্ষা করতে হয় মৃত্যুর। একসময় সেটাও চলে আসে। আমরা নিজেরাই হয়ে যায় প্রাক্তন। সম্পন্ন হয় আমাদের প্রাক্তন চক্র। আমাদের মৃত্যুর দু-একদিন হয়তো পরিবারের মানুষরা কান্না করে, মন খারাপ থাকে কিছুদিন এরপর সব আগের মতোই। হয়তো নাতি-নাতনিকে শোনানো কিছু প্রাক্তন থেকে যায় গল্প হিসেবে। বাকিগুলো বিলিন হয়ে যায় আমাদেরই সাথে।
অনুগল্প-প্রাক্তন
অডিও মোড
00:00
00:00
গতি:
ভলিউম:
200
Views
4
Likes
2
Comments
5.0
Rating